ভরপুর বাঙালি য়ানায় মোরা এডিনবার্গের পুজো
দুর্গাপুজো শুরুর মাস তিনেক আগে থেকেই এবার সবার মন খারাপ। বছরের এই একটা সময় কলকাতা আর বিদেশ মেতে ওঠে উৎসবে।বাড়ি ফেরার সময়, প্রবাসী বাঙালির মন আকুল হয়ে ওঠে।এটাই আড্ডা মারার সেরা সময়। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে বন্ধুরা এসে জড়ো হয় পাড়ার আড্ডায়। রাত নেই, দিন নেই– অনর্গল আড্ডা।আর তার সঙ্গে খাবার দাবার।কিন্তু এইবার মন খারাপের পালা চলছে সবার।
সমাজ মাধ্যমে কিছু আধা পরিচিত অর্বাচীন লিখেছে,” পুজোর ওই কটা দিন , কত লোক সারা বছর বসে থাকে শুধু পুজোতে দু পয়সা কমাবে বলে, দুর্গোৎসবে তিলোত্তমার আলোচনা কতবার করতে হবে ? যা হয়েছে, তা তো যথেষ্ট নিন্দনীয়। আমরা বিচার চাই, মিটিং মিছিল করছি তো, পথে নেমেছি। কিন্তু এর মধ্যে কিছু পুজোতে কেনা হলো না ?”
আবার কেউ বলছে, ” আরে বাবা, এটা তো কলকাতায় আকছর হচ্ছে, প্রথম না , সব ধরা পড়বে”!
এবারে মহালয়ার দিনটা গুলিয়ে গেছিল। সুদূর এডিনবার্গ শহরে কার-ই বা মনে থাকে মহালয়া? ভোরবেলা মহালয়ার কথা মনে করিয়ে দিলো আমার আরেক প্রবাসী বন্ধু, জানালো, পুজো উপলক্ষে কলকাতায় এসেছে।
পুজো শুরু হতে হাতে আর মাত্র কটাদিন। আর বরাবরই বাঙালি,কলকাতা আর দুর্গাপুজো মিলেমিশে যেরকম একাকার হয়ে যায় ঠিক তেমন ভাবে প্রবাসী বাঙালি, প্রবাস আর পুজো একাত্ম হয়ে যায়। তবে পুজো মানেই কলকাতা, আর কলকাতা মানেই পুজোর আসল আনন্দ। তবে এবার কলকাতার আকাশে-বাতাসে সেভাবে এখনও দুর্গাপুজোর গন্ধ নেই।
গত ৯ অগস্টের পর থেকে শহরবাসী মন বড়ই খারাপ। আর এবার বোধ হয় মা এরও ‘মন ভালো নেই’, আসার সময় থেকেই নেই।
ছোটবেলায় দুর্গাপুজো আমাদের কাছে কেবল একটি পুজো ছিল না। পুজোর আছিলায় গড়ে ওঠা এক সাংস্কৃতিক আবাদভূমি ছিল। পাড়ার স্টেজে নাটক হবে বলে ছেলে-মেয়েরা একমাস ধরে মহড়া দিত। মাঠে মাঠে ছেলে ছোকড়ার দল সদ্য কেনা গিটারে সুর ধরতো নচিকেতা, সুমনের আর অঞ্জন দত্তের। ইদানিং আবার বাউল, ভাটিয়ালি, আধুনিক শুরু হয়েছে বেশ কিছু সময় ধরে, ” মরুতে এলেন মহম্মদ, মথুরাতে এলেন শ্যাম’ সুর তুলে পাড়ার সান্ধ্য অনুষ্ঠানে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল বন্ধু রাজা। দুর্গাপুজোয় কেন ‘মহম্মদে’র নাম এলো, এ প্রশ্ন কেউ কখনো তোলেননি। ইদানীং তোলেন। মধ্য কলকাতায় পুজো প্যান্ডেলে তাজমহল দেখেছি আমরা। থিম-টিমের তখনো কোনো বালাই ছিল না। পুজো ছিল এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।
কলকাতার পুজো এখন এক মস্ত বড় ইন্ডাস্ট্রি। শিল্পক্ষেত্রও বটে। কুমোরটুলির শিল্পী থেকে আর্ট কলেজের ছাত্র– কলকাতার থিম পুজো এখন বহু মানুষের সারা বছরের রুটিরুজি। গত বছর ঢাক বাজানোর বায়না না পেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন যে ঢাকি, আমার তার জন্যে মন খারাপ। ঠাকুর বিক্রি না হওয়ায় কুমোরটুলির যে শিল্পী বিপুল দেনার দায়ে জর্জরিত, আমার তার জন্য কষ্ট হয়। কিন্তু থিম নামক জৌলুস যখন গোটা সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেয়, তখন মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয়, যখন দেখি থিম বিক্রি করতে গিয়ে নৃশংস ভাবে অত্যাচারীদের হাতে শিকার হওয়া মেয়েদের কথা শিকেয় তুলে দিয়েছেন স্বয়ং রাজ্যের কিছু গোষ্ঠী আর দল। মন খারাপ হয়, যখন দেখি কলকাতার বাঙালি থিমের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে মাখা মাখি চলে, মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি প্যান্ডেলে কেন হিন্দু দেবীর বোধন হবে, এ প্রশ্নও উঠছে আজকাল। নাহ, এ পুজো তো আমরা চাইনি, পুজোর নামে সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা আমরা চাই নি, চাই নি নেতাদের নামে পুজোর ব্যানার দেখতে মোটেই। চাই না, দুর্গাপ্রতিমার আদলে রাজ্যের কারুর মূর্তি তৈরি হোক। কিংবা আলোকসজ্জা। এই সংস্কৃতি বাংলার সংস্কৃতি নয়। চাই না, পুজোয় এই অপসংস্কৃতি দেখতে।
এ কথা অনস্বীকার্য, দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল কলকাতার শিল্পবোধকে বিশ্বের দরবারে ইউনেস্কো হেরিটেজের মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছে। পুজোর কয়েকটা দিন সত্যি সত্যিই মনে হয়, গোটা কলকাতা জুড়ে হাজার হাজার লাইভ বিশ্বমানের ইনস্টলেশন তৈরি হয়েছে। কত কষ্ট, রক্ত জল করা খাটুনি, কত ঘাম, না ঘুমোনো রক্তাভ চোখ। শিল্পীর চোখে সাধারণ পুজো এক অনন্য সাধারণ মাত্রায় পৌঁছে যায়। পুজো কেবল আর পুজো থাকে না, উৎকৃষ্ট উৎসবে পরিণত হয়। আবার একথাও ঠিক, ওই বিপুল রোশনাইয়ের পাশে যখন সমাজের কষ্ট পাওয়া, অত্যাচারিত মুখগুলো ভেসে ওঠে, যেন ফিস ফিস করে বলে, ” আমরা বিচার পাবো তো? এই পোড়া দেশে সত্যিই বিচার পাবো? তোমরা আমার মা বাবাকে দেখে রাখবে তো?”
হা ঈশ্বর, তখন মনে হয় তাদের সুবিচার পাওয়ার কথা ছিল, নিজের মন আর বাঁধ মানে না, সত্যিই তো আমাদের তো সবার মিলে তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল, পুজোর নয়।
আমরাও তাই বাদ, প্রতিবাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি এই সুদূর স্কটল্যান্ডে এডিনবার্গ শহরে। আমাদের বাঙালি দলে, সবাই মিলে আয়োজন করছি এই বছর পুজোর। মা আসছেন আলো করে , আকাশ বাতাসে যেন পুজো পুজো ভাব, ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া সেই শিউলি পুলের গন্ধ যেন এখন হারিয়ে যায়নি। মন খারাপ যদিও আমাদের সবার প্রিয় শহর কালিমালিপ্ত হওয়ায়, তিলোত্তমা কে আমার শহর দিতে পারেনি নিরাপত্তা। তাও এইবার মা এর কাছে প্রার্থনা , ” মা, তুমি আসছ, দেখো মেয়েটা যেন বিচার পায়, সবাই যেন বিচার পায় যারা এই ভাবে অত্যাচারিত আর লাঞ্ছিত হয়”l
বছরের এই সময়টায় আরো অনেক বাঙালির মতো, আমারও মন ভালো থাকে। আনন্দ করতে ইচ্ছে হয় সর্বক্ষণ। সম্ভবত এই প্রথম পুজোর মরসুমে মন ভালো নেই। পুজো ঘিরে যে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো তৈরি হলো, তা বড়ই বেদনাদায়ক। এই ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো আমাদের এই প্রবাসী জীবনে যে প্রতিঘাত নিয়ে পৌঁছালো, তা আরো বেশি মন খারাপের। এর দায় আমাদের সকলের। আরও কি যে দেখা বাকি কে জানে এই জীবনে।